কুরবানী: আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মহোৎসব

কুরবানী: আত্মত্যাগ ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের মহোৎসব

কুরবানী (আরবি: قربانى), যা আদ্বহা বা আযহা (أضحية) নামেও পরিচিত, হিজরি পঞ্জিকার জিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক উৎসব। এটি শুধুমাত্র একটি পশুবলির অনুষ্ঠান নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কার লাভের আশায় নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির দ্বারা নির্দিষ্ট পশু জবাই করার এক গভীর ইবাদত। কুরবানী মূলত আত্মত্যাগ, বিনয় ও আল্লাহর প্রতি চরম আনুগত্যের প্রতীক।

কুরবানী কী?

ইসলামী আইন অনুযায়ী, কুরবানী হলো ঈদ উল আযহার সময় পশু উৎসর্গের একটি বিধান।
পবিত্র আল কোরআনে তিনটি স্থানে কুরবানীর উল্লেখ রয়েছে; এর মধ্যে একটি সরাসরি পশু কুরবানীর ক্ষেত্রে এবং বাকি দুটি সাধারণ সৎকর্ম বা ভাবনাকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
জিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য পশু জবাই করাকে ইসলামে কুরবানী বলা হয়।

শাব্দিক অর্থ

কুরবানী শব্দটি হিব্রু কোরবান (קרבן) এবং সিরিয়াক ভাষার কুরবানা শব্দ দুটির সঙ্গে সম্পর্কিত, যার আরবি অর্থ হলো "কারো নিকটবর্তী হওয়া"। এই অর্থই কুরবানীর মূল উদ্দেশ্যকে ফুটিয়ে তোলে: আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছানো।

কুরবানীর উৎপত্তি: 

একটি প্রাচীন ইতিহাস,
ইসলামের কুরবানীর ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। পবিত্র আল কোরআনে হাবিল ও কাবিলের কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে। হাবিল ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে একটি পশু কুরবানী দেন। ইবনে কাসিরের বর্ণনা অনুযায়ী, হাবিল একটি ভেড়া এবং তার ভাই কাবিল তার ফসলের কিছু অংশ আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। আল্লাহর নির্দেশ ছিল যে আকাশ থেকে আগুন নেমে এসে গ্রহণযোগ্য কুরবানী গ্রহণ করবে। সেই অনুযায়ী, আগুন নেমে আসে এবং হাবিলের জবাইকৃত পশুর কুরবানী গ্রহণ করে। অন্যদিকে, কাবিলের ফসলের কুরবানী প্রত্যাখ্যাত হয়। এই ঘটনায় কাবিল ঈর্ষান্বিত হয়ে এবং সামাজিকভাবে অপমানিত বোধ করে তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে, যা মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকাণ্ড হিসেবে পরিচিত। কাবিল তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেননি। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, কুরবানীতে শুদ্ধ নিয়ত ও নিষ্ঠা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

ইব্রাহীমের মহাত্যাগ: ঈমানের শ্রেষ্ঠ পরীক্ষা

কুরবানীর সবচেয়ে সুপরিচিত ইতিহাসটি জড়িত রয়েছে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর মহাত্যাগের সঙ্গে। ইসলামের বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তা’আলা হযরত ইব্রাহীমকে স্বপ্নযোগে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তুটি কুরবানী করার নির্দেশ দেন: “তুমি তোমার প্রিয় বস্তু আল্লাহর নামে কোরবানি কর”। প্রথমবার ইব্রাহীম (আ.) এই আদেশ পেয়ে ১০টি উট কুরবানী করেন। পুনরায় একই স্বপ্ন দেখে তিনি ১০০টি উট কুরবানী করেন। এরপরও যখন একই স্বপ্ন দেখলেন, তখন তিনি ভাবলেন, এ মুহূর্তে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.) ছাড়া আর কোনো প্রিয় বস্তু নেই।
এরপর তিনি পুত্রকে কুরবানী দেওয়ার উদ্দেশ্যে আরাফাতের ময়দানে যাত্রা করেন।
যখন ইব্রাহীম (আ.) আরাফাত পর্বতের উপর তাঁর পুত্রকে কুরবানী দেওয়ার জন্য গলদেশে ছুরি চালানোর চেষ্টা করেন, তখন তিনি বিস্মিত হয়ে দেখেন যে তাঁর পুত্রের পরিবর্তে একটি প্রাণী কুরবানী হয়েছে এবং তাঁর পুত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি।
এই অলৌকিক ঘটনাটি ছিল ইব্রাহীম (আ.)-এর ঈমানের চরম পরীক্ষা এবং আল্লাহর প্রতি তাঁর অবিচল আনুগত্যের প্রমাণ।
এই ঘটনাকে স্মরণ করেই সারা বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বছর ঈদ উল আযহা (ত্যাগের ঈদ) উদযাপন করেন।

ধর্মীয় কুরবানী ও এর বিধান

ইসলামে, হিজরী ক্যালেন্ডারের ১২তম চন্দ্র মাস জিলহজ্জের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত কুরবানী করার সময় নির্ধারিত। এই দিনে সারা বিশ্বে মুসলমানরা কুরবানী প্রদান করেন, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট দিনে একটি পশুকে জবাই করার অর্থ। এটি ইব্রাহীমের পুত্র ইসমাইলের পরিবর্তে একটি মেষের আত্মত্যাগের পুনরাবৃত্তি, যা ইহুদিধর্মেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা এবং ইসলাম এই ঘটনাকে বিশ্বাস করে। এই উপলক্ষে ইসলামিক ধর্মপ্রচারকগণ উক্ত ঘটনাটির উল্লেখ করে মানব সেবায় মুসলমানদেরকে তাদের সময়, প্রচেষ্টা এবং সম্পদ নিয়ে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত করে থাকেন।

ফিকাহ শাস্ত্র অনুযায়ী, পশুটিকে অবশ্যই জবেহর নিয়ম মেনে হত্যা করতে হবে এবং পশুটি একটি গৃহপালিত ছাগল, ভেড়া, গরু বা উট হতে হবে।
শহীদ ও কুরবানী

কুরবানী শব্দটি শুধুমাত্র পশুবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ইসলামের জন্য শহীদ হওয়া বোঝাতেও কুরবানী শব্দটি ব্যবহৃত হয়, যা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগকে নির্দেশ করে। আবার, ব্যক্তির সম্পদ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে বিলিয়ে দেওয়াকে আল্লাহর রাস্তায় কুরবানী বলা হয়ে থাকে, যা দানশীলতা ও ত্যাগের গুরুত্বকে তুলে ধরে।

পবিত্র কোরআনে কুরবানী

মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ পবিত্র কোরআন শরীফে কুরবানী সম্পর্কিত একাধিক সুরা উল্লেখ করা হয়েছে, যা এর গুরুত্ব ও অন্তর্নিহিত অর্থকে স্পষ্ট করে।

সূরা বাকারা, আয়াত ১৯৬: "অতএব হে মানুষ! আল্লাহ-সচেতন হও। আল্লাহর ধর্মবিধান লঙ্ঘন হতে দূরে থাকো। জেনে রাখো, আল্লাহ মন্দ কাজের শাস্তিদানে কঠোর।"
সূরা মায়েদা, আয়াত-২৭: "হে নবী! কিতাবিগণকে আদমের দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের ঘটনা ভালো করে বর্ণনা করো। তারা যখন কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো। কিন্তু অন্যজনের কোরবানি কবুল হলো না। ক্ষিপ্ত হয়ে সে বলল, আমি তোমাকে খুন করবো। অপরজন বলল, প্রভু তো শুধু আল্লাহ-সচেতনদের কোরবানিই কবুল করেন।"
সূরা আনআম, আয়াত ১৬২-১৬৩: "হে নবী! ওদের বলুন, আমার সালাত, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ-আমার সবকিছুই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহরই জন্যে। তিনি একক ও অদ্বিতীয়। এ আদেশই আমি পেয়েছি। আমি সমর্পিতদের মধ্যে প্রথম।"
সূরা হজ, আয়াত ৩৪-৩৫: "আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কোরবানিকে ইবাদতের অংশ হিসেবে নির্ধারণ করেছি। যাতে জীবনোপকরণ হিসেবে যে গবাদি পশু তাদেরকে দেওয়া হয়েছে, তা জবাই করার সময় তারা আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে এবং সব সময় যেন মনে রাখে যে একমাত্র আল্লাহই তাদের উপাস্য। অতএব, তাঁর কাছে সম্পূর্ণরূপে সমর্পিত হও। আর সুসংবাদ দাও সমর্পিত বিনয়াবনতদের, আল্লাহর নাম নেওয়া হলেই যাদের অন্তর কেঁপে ওঠে, যারা বিপদে ধৈর্য ধারণ করে, নামাজ কায়েম করে এবং আমার প্রদত্ত জীবনোপকরণ থেকে দান করে।"
সূরা হজ, আয়াত ৩৬: "কোরবানির পশুকে আল্লাহ তাঁর মহিমার প্রতীক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তোমাদের জন্য এতে রয়েছে বিপুল কল্যাণ। অতএব, এগুলোকে সারিবদ্ধভাবে বাঁধা অবস্থায় জবাই করার সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করো। এরপর যখন তারা জমিনে লুটিয়ে পড়ে, তখন তা থেকে মাংস সংগ্রহ করে তোমরা খাও এবং কেউ চাক না চাক সবাইকে খাওয়াও। এভাবেই আমি গবাদি পশুগুলোকে তোমাদের প্রয়োজনের জন্য নির্ধারণ করেছি।"
সূরা হজ, আয়াত ৩৭-৩৮: "কিন্তু মনে রেখো, কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না; আল্লাহর কাছে পৌঁছায় কেবল তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা। এই উদ্দেশ্যে কোরবানির পশুগুলোকে তোমাদের অধীনে দেওয়া হয়েছে। অতএব, আল্লাহ তোমাদের সৎপথ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে কল্যাণ দিয়েছেন, তার জন্য তোমরা আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করো। হে নবী! আপনি সৎকর্মশীলদের সুসংবাদ দিন যে, আল্লাহ বিশ্বাসীদের রক্ষা করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞকে পছন্দ করেন না।"
সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২: "যখন ছেলে পিতার কাজকর্মে অংশগ্রহণের উপযুক্ত হয়ে উঠল, তখন একদিন ইব্রাহিম তাকে বললেন, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে কোরবানি দিতে হবে। এখন বলো, এ বিষয়ে তোমার মতামত কী? ইসমাইল জবাবে বলল, হে আমার পিতা! আপনাকে যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাই করুন। ইনশাল্লাহ! আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে বিপদে ধৈর্যশীলদের একজন হিসেবেই পাবেন।"

সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৬-১১০: "মনে রেখো, এটি ছিল একটি স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে এক মহান কোরবানির সুযোগ দিয়েছিলাম। পুরো ঘটনাটি প্রজন্মের পর প্রজন্মে স্মরণীয় করে রেখেছি। ইব্রাহিমের প্রতি সালাম। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করি।"

সূরা কাওছার, আয়াত ২-৩: "অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্য নামাজ পড় এবং কোরবানি দাও। নিশ্চয়ই যিনি তোমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবেন, তার বংশধারা বিলুপ্ত হবে।"

কুরবানী শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট দিনের অনুষ্ঠান নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস, কৃতজ্ঞতা এবং আত্মত্যাগের একটি ধারাবাহিক অঙ্গীকার। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জীবনের সবকিছুই আল্লাহর দান এবং তাঁর পথে ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে প্রকৃত শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব।

কুরবানীর মাধ্যমে কীভাবে সমাজের দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের সাথে সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়, সে সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

মন্তব্যসমূহ